অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল
বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পথে। এক মাসের ফুটবলময় নির্ঘুম রাতের শেষে বাঙালি আবার ব্যস্ত হয়ে পড়বে তাদের প্রাত্যহিক রুটিন কাজে। এবারের বিশ্বকাপের একটা উল্লেখযোগ্য দিক ছিল একের পর এক অঘটন। সবচেয়ে বড় অঘটনগুলোর একটা নিঃসন্দেহে ছিল প্রারম্ভিক রাউন্ডে সৌদি আরবের হাতে আর্জেন্টিনার ধরাশায়ী হওয়াটা।
এই জয়ে সৌদি ফুটবলাররা নগদ এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর সঙ্গে একটা করে রোলস রয়েস পেয়েছেন রাজকীয় উপহার হিসেবে। দেখা যাক, বাঙালি কি পেল! আমাদের আশা ছিল সৌদি দলের বিজয়ে রাজপথে বিশাল মিছিল নামবে- যেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কার্যত তেমন কিছুই হয়নি, কিন্তু তাতে বরং শঙ্কাটা আরও বেড়েছে।
যে দেশে কিছু মানুষ ভারতের বিপক্ষে তো বটেই, এমনকি বাংলাদেশের বিপক্ষেও ঢাকার স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে সমর্থন করে দেশটিকে, আর দাঁড় করায় ইসলামপ্রীতি আর ক্রীড়া প্রেমের খোঁড়া যুক্তি, সেই দেশের সেই মানুষগুলো যখন সৌদি ফুটবল টিমের ক্রীড়া নৈপুণ্য আর আর্জেন্টিনার পরাজয়ে রাস্তায় মিছিল না করে, বরং ঘরের ভেতরে ঘাপটি মারে, তখন কেন যেন শঙ্কা জাগে যে, না ক্রীড়া প্রেম, না ইসলামপ্রীতি- তাদের এই ব্যাখ্যাতীত আচরণের মূলে আছে আসলে পাকিস্তান প্রীতি।
ধর্মকে ব্যক্তির জীবনাচারের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে রেখে রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে তাকে পৃথক রাখাই ছিল বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার মূল বিষয়। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার এই সংজ্ঞাটি কামাল আতাতুর্ক কিংবা ভøাদিমির ইলিচ লেনিনের ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা থেকে একেবারেই আলাদা। তারা যেখানে ধর্মকে নিষিদ্ধ করেছিলেন, সেখানে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তি জীবনে ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।
ইসলামী ফাউন্ডেশন কিংবা ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রতিষ্ঠা, ঘোড়দৌড় নিষিদ্ধ করাসহ বঙ্গবন্ধুর সময় নেওয়া এমন অনেক সিদ্ধান্ত এর সাক্ষ্য। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুই এই উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো ধর্মরিপেক্ষতাকে সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে সন্নিবেশিত করেছিলেন। অথচ হলফ করে বলার জো নেই যে, বঙ্গবন্ধুর সেই বাংলাদেশটি আজ তার স্বপ্নের বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে।
উন্নয়নের মহাসড়কে আমাদের অগ্রযাত্রা ঠিকঠাক মতোই চলছে। আমরা গণতন্ত্রকেও মোটামুটি একটা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছি। আর বাংলাদেশ যে একটি ওয়েলফেয়ার স্টেট, তা করোনাকালেই পুরো জাতিকে বিনামূল্যে কোভিড ভ্যাকসিন দিয়ে সরকার তা আরও একবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গাটাতে আমাদের দুর্বলতা দৃষ্টিকটু।
সেকারণেই ঢাকার রাজপথে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের সময় ‘আমি রাজাকার’ টি-শার্ট পরে কিংবা চট্টগ্রামের জনসভায় রাজকার শাবক বড় গলায় কথা বলে জুতার মালা গলায় না নিয়েই নির্বিঘেœ ঘরে ফিরতে পারে।
ভাবছিলাম কোথায় ছন্দের পতনটা ঘটল? সহজ উত্তরটা দেখিয়ে দিলেন বন্ধুপ্রতিম একজন অগ্রজ চিকিৎসক। যে বাঙালি একদিন দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ছিল, তারাই মাত্র দুই যুগের ব্যবধানে বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রটি সৃষ্টি করেছিল। বাঙালির ভেতর যারা প্রজ্ঞাবান তাদের পাকিস্তান রাষ্ট্রটির অকার্যকারিতা বুঝতে দুই বছরও সময় লাগেনি।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দ্রুতই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে একটি সফল পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশের একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী তখনও পাকিস্তান প্রেমেই বুঁদ হয়েছিল। যে কারণে সত্তরের যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়, এমনকি সেই নির্বাচনেও কমবেশি ত্রিশ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি। অন্য কথায় তারা পাকিস্তানকেই সমর্থন করেছে। বাংলাদেশ চায়নি। আর ঠিক সে কারণেই পাকিস্তানিরা যে কাজটি করার দুঃসাহস দেখায়নি, সেই কাজটি করে দেখিয়েছে বাঙালিই। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে শাহাদাতবরণ করতে হয়েছে বাঙালির হাতে।
সেই ষড়যন্ত্রে শামিল হয়েছিল আওয়ামী লীগের কিছু কুলাঙ্গারও। দুঃখের বিষয়, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর হাতে সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিনটি বছর। আর তারপর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের বেশিরভাগ সময়জুড়েই ক্ষমতায় থেকেছে ওই ‘পেয়ারে পাকিস্তানিরাই’।
প্রশ্ন হচ্ছে, সমাধানটা কোথায়? সমাধানটা সহজ, কিন্তু তা বাস্তবায়নের পথ সঙ্গত কারণেই কঠিন। এর জন্য প্রথম যে কাজটি করতে হবে, তা হলো ইতিহাসকে সংশোধন করে ইতিহাসের জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। পৃথিবীতে সবসময় বিজয়ী জাতি তার ইতিহাস লিখেছে। অথচ বাংলাদেশের বেলায় ঘটেছে ঠিক তার উল্টো।
আজ এই ডিসেম্বরে বসে আমরা যদি স্বাধীন বাংলাদেশের একান্ন বছরের ইতিহাসের ব্যবচ্ছেদ করি, তাহলে সে কথা আশা করি কেউ অস্বীকার করবেন না যে, নানা অপ্রাপ্তির বেদনা থাকলেও গত একটি যুগেই বাংলাদেশ সঠিক পথে এগিয়েছে। জয় বাংলা আজ আমাদের জাতীয় স্লোগান। এটি আমাদের একযুগের অর্জন, আর যদি আমরা জয় বাংলাকে সত্যি-সত্যি বাংলাদেশের পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, অর্থাৎ সুসংহত করতে চাই গত একটি যুগের অর্জনকে, তাহলে আগামী দুই থেকে তিন যুগ এদেশে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির নিরবচ্ছিন্ন শাসনে কোনো ছেদ পরতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই।
লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ